আজকের অমর্ত্য সেন সেদিনের শরৎচন্দ্রের চোখে

লেখক – সৈকত গোলদার

জন্মের সময় আমরা একটা জন্তু হয়ে জন্মাই। কিন্তু সংস্কৃতিই আমাদের মানুষে পরিণত করে। পরিণত করে সামাজিক জীবে। সংস্কৃতি দিয়েই একটা মন মানসিকতা, ধ্যান ধারনার অধিকারী হই। আবার তেমন সংস্কৃতির আবহাওয়ায় লালিত হলে সাধারণ মনুষ্য- সন্তান ও জন্তুতে অর্থাৎ অমানুষে পরিণত হতে পারে। ধর্মের ধোঁয়াশা সূর্যের মতো প্রতিভাকেও দূরে সরিয়ে রাখতে পারে। আজ যারা অমর্ত্য সেনকে আক্রমণ করছে তারাই আক্রমণ করেছিল একদিন রাজা রামমোহন রায়কে, বিদ্যাসাগরকে। বিদ্যাসাগরের মতো ব্যক্তি যিনি জীবদ্দশাতেই করুণার সাগর ও বিদ্যাসাগর উপাধি পেয়েছিলেন তারও দুর্নামের অভাব হয়নি। বিধবা বিবাহ আইন করায় ওনাকে এই ধর্মের পেয়াদা যারা আজ অমর্ত্য সেনকে গালাগালি করেছেন তারাই বিদ্যাসাগর কে আক্রমণ করেছিলেন গালাগালি করেছিলেন। সতীদাহ প্রথা রদ করার অপরাধে রাম মোহনকে আজকের পেয়াদারাই ত্যাজ্য পুত্র করতে বাধ্য করেছিলেন, এক ঘরে করে রেখেছিলেন। একটা প্রশ্ন, শরৎচন্দ্র কেন বিধবা বিবাহ দেননি? শরৎচন্দ্র নিজে কিছু করতেন না পাঠকের ওপর ছেড়ে দিতেন কী করা উচিত আপনি বুঝুন, এটাই ছিল ওনার বৈশিষ্ট্য। এবিষয়ে শরৎ চন্দ্রের সেই বক্তব্যটা মনে পরে, যেখানে রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্রকেও কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছিলেন “বিধবা বিবাহ মন্দ হিন্দুর ইহা মজ্জাগত সংস্কার। গল্প উপন্যাসের মধ্যে বিধবা নায়িকার পুনর্বিবাহ দিয়া কোনও সাহিত্যিকেরই সাধ্য নেই নিষ্ঠাবান হিন্দুর চোখে সৌন্দর্য সৃষ্টি করবার। পড়বামাত্র মন তার তিক্ত বিষাক্ত হয়ে উঠবে। গ্রন্থের অন্যান্য সব গুনই তার কাছে ব্যর্থ হয়ে যাবে। স্বর্গীয় বিদ্যাসাগর মহাশয় যখন গভর্নমেন্টের সাহায্যে বিধবা বিবাহ বিধিবদ্ধ করেছিলেন, তখন শাস্ত্রের বিচার করেছিলেন, হিন্দুর মনের বিচার করেননি। তাই আইন পাশ হল বটে কিন্তু হিন্দু সমাজ বিদ্যাসাগরকে গ্রহণ করতে পারল না। তাঁর অতবড় মহান চেষ্টা নিষ্ফল হয়ে গেল। নিন্দা, গ্লানি, নির্যাতন তাকে অনেক সইতে হয়েছে। কিন্তু তখনকার কোনও সাহিত্যসেবী তাঁর পক্ষ অবলম্বন করলেন না। এ অভিযোগ তাঁর বঙ্কিমচন্দ্র সম্পর্কেও রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কেও। তারপর বলেছেন। “হয়তো এই অভিনব ভাবের সঙ্গে তাঁদের সত্যই সহানুভূতি ছিল না। হয়তো তাঁদের সামাজিক অপ্রিয়তার অত্যন্ত ভয় ছিল। যে জন্যই হোক সেদিনের সেই ভাবধারা সেখানেই রুদ্ধ হয়ে রইল। সমাজদেহের স্তরে স্তরে গৃহস্তের অন্তঃপুরে সঞ্চারিত হতে পেল না। কিন্তু এমন যদি না হত, এমন উদাসীন হয়ে যদি তাঁরা না থাকতেন, নিন্দা, গ্লানি নির্যাতন সকলেই তাদেরকে সইতে হত সত্য, কিন্তু আজ হয়তো আমরা হিন্দুর সামাজিক ব্যবস্থার আর একটা অন্য চেহারা দেখতে পেতাম। সেদিনের হিন্দুর চোখে যে সৌন্দর্য সৃষ্টির কদর্য, নিষ্ঠুর ও মিথ্যা প্রতিভাত হত, আজ অর্ধশতাব্দী পরে তাই দেখে হয়তো আমাদের নয়ন ও মন মুগ্ধ হয়ে যেত। সাহিত্য সাধনায় নবীন সাহিত্যিকের এইতো সবচেয়ে বড় সান্ত্বনা। সে জানে আজকের লাঞ্ছনাটাই তাঁর জীবনে একমাত্র এবং সবটুকু নয়। অনাগতের মধ্যে তারও দিন আছে। হোক সে শতবর্ষ পরে কিন্তু সেদিনের ব্যাকুল ব্যথিত নর নারী শতলক্ষ হাত বাড়িয়ে আজকের দেওয়া সমস্ত কালি মুছে দেবে”।
শরৎচন্দ্রের ভাষায় অমর্ত্য সেন শিরদাঁড়া সোজা রেখে উদারনৈতিক রাজনীতিতে অংশ গ্রহণ করেছেন, তিনি সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা পাবেন না জেনেও প্রতিবাদের ভাষা দেগেছেন বারবার এই বর্বর অভিব্যক্তিদের বিরুদ্ধে। আজকের দিন যখন ইতিহাস হবে অমর্ত্য সেন সেদিন ফিরে পাবেন আগামীদের কাছে তাঁর সম্মান। সেদিনের বিদ্যাসাগরের শত্রু, রামমোহনের শত্রুরাই আজকের অমর্ত্য সেনের শত্রু। এতে বিদ্যাসাগর, রাম মোহন বা অমর্ত্য সেনদের কিছু যায় আসে না তাঁরা নিজেদের শিরদাঁড়া সোজা রেখেই জীবন অতিবাহিত করে। (মতামত লেখকের ব্যাক্তিগত)