রাধামাধব মণ্ডল :
আরএসএস এর দুর্গা, কিংবা মমতার গদ্দার এঁদের বাইরেও নন্দীগ্রামের যুদ্ধক্ষেত্রে রয়েছেন বহুমানুষ! শুভেন্দু মাইতিকে মনে পড়ে! তেমনই একজন মানুষ তিনি! মনে পড়ে কমরেড লক্ষণ শেঠ! হ্যাঁ, কমরেড তখন লক্ষণ শেঠরা। সাদা বিদ্যাসাগরী ধুতি পড়ে মানুষটা মস্ত বড় পার্টি অফিসের থেকে নেমে আসছেন! চোখমুখ লাল! বহু ভারিক্কি কথায় একপ্রকার অপমানিত হয়েই নন্দীগ্রামের কমিউনিস্ট পার্টির কর্পোরেট অফিস থেকে বেড়িয়ে এসেছিলেন আদর্শে অবিচল একটা মানুষ!
একজন কমিউনিস্ট! সেদিন প্রাণের প্রিয় কমিউনিস্ট পার্টির উপর তলার নেতারাও লক্ষণের গণ্ডিতে! নন্দীগ্রামের কালো-অধ্যায়ের সেই নায়ক চলে গেলেও, তাঁর পাপ আজও বইছে সিপিএম! সেদিন শুভেন্দু মাইতি প্রশ্ন তুলেছিলেন! তারপর বহুকাল গেছে! সময়ের ক্রুদ্ধ শাসনে লক্ষণ আজ বাঘ থেকে ছারপোকা! কেউ পাত্তাই দেয়না, একসময়কার দোদণ্ডপ্রতাপ এই সিপিএম নেতাকে। কিন্তু সেই শুভেন্দু মাইতি এখনও কমিউনিস্ট! আজও তাঁর সাদা কাপড়ে লাগেনি দাগ! তাঁর নিজস্বী গুণে এখনও তিনি মঞ্চে গাইছেন লোকগান।
তাঁর হাজার হাজার তৈরি ছাত্র ছাত্রী গোটা বাংলা এবং বাংলার বাইরেও বাংলাগানের ডালিকে সাজিয়ে নিয়ে বয়ে বেড়াচ্ছেন। সেখ সুফিয়ানরাও তাঁকে ছাড়েনি! আদর্শের জন্য তাঁকে আজও আপামর বাংলা ও বাঙালিরা ভালো বাসেন। কবীর সুমনও তাঁর ছাত্র এবং ভক্ত। বর্তমান সময়ের রাজনীতিতে হয়তো আর তেমন ভাবে তিনি থাকতে পারেননা। তবে আজও তিনি স্বপ্ন দেখেন, শ্রমেবোনা আকাশটা আবার একদিন লাল হবে।
আকাশ জুড়ে ধ্বনিত হবে “ইনক্লাব জিন্দাবাদ “। আর তখন কোঁকড়া চুলের বেঁটেখাটো মানুষটা, নন্দীগ্রামের মাটিতে দাঁড়িয়েই গান ধরবেন, “শালকু সরেনের লাশ..”। আজ কমরেড লক্ষণ আদর্শ চ্যুত! ষড়যন্ত্রকারী শুভেন্দু অধিকারীরাও দ্বন্দ্বে বিভক্ত! শরীরে রোগের বোঝা, বঞ্চিত নন্দীগ্রামের মাটিতে একাএকা ছুটে বেড়াচ্ছে মেয়েটা! ঘুমাতে পারছেন না গায়ক শুভেন্দু মাইতি। মন চাইলেও শরীর এবং ডাক্তাররা তাঁকে যেতে দিতে চাইছে না, যুদ্ধের মাটিতে। সেই আপোষহীন লড়াই এখনও তিনি রণক্ষেত্রেই আছেন!
এবার ২০২১ এর বিধানসভা নির্বাচনে আড়াআড়ি দু’ভাগ নন্দীগ্রাম। একা একজন প্রার্থী একটানা কেবল সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের তাস খেলছেন নন্দীগ্রামে! বলছেন, আমি এমাটির ছেলে! একদা মমতার বিশ্বস্ত সৈনিক আজ চিরশত্রুর মতো আক্রমণে প্রতিদ্বন্দ্বী! তিনি বহিরাগত! গুরু শিষ্যের লড়াই! সত্য মিথ্যার কদর্য আক্রমণ প্রতিআক্রমণে গোটা দেশের নজরে রয়েছে নন্দীগ্রাম! কাঁথির শুভেন্দুও রাজনীতিতে টিকে থাকার লড়াইএ নেমেছে। তাঁর নতুন দলও তাঁকে মহাপরীক্ষায় ফেলেছে! বাঘিনীর সঙ্গে লড়তে!নিন্দুকে বলছেন, জননেতার পরীক্ষা দিতে হবে তাঁকে!
মমতা আর শুভেন্দু অধিকারীর লড়াইএর ভিত্তি ধর্মীয় মেরুকরণ। মুসলমানের ২৫%, আর হিন্দুরা ৭৫%, এই অঙ্কে শুভেন্দু অধিকারী আর মমতার লড়াই! দারিদ্র, দুর্নীতি, ভাঙা রাস্তা, বেকারি, কথা না রাখা, চিকিৎসা, স্কুল-কলেজের উন্নতি, লকডাউনের প্রভাব, পরিযায়ী শ্রমিকদের অবস্থা, আমফানের রিলিফ দুর্নীতি, কাজ নেই এসব নিয়েই একটি তরুণীর লড়াই। তিনি শ্লোগান তুলেছেন, “খালি পেটে রামের নাম, ৯০০ টাকা গ্যাসের দাম”। তৃণমূল-বিজেপির ভারী ভারী নেতা-নেত্রীদের যাওয়া আসা, তার মাঝেই তিনি ছোটছোট করে ঘর-গুচাচ্ছেন আগামীর জন্য।
ভিতর এবং বাইরের লোক এনে জমায়েত করছে বিজেপি, তৃণমূল। যা দেখে হাওয়ায় গতি বোঝা দুঃসাধ্য। রেডস্টারেদের একটা বড় সমর্থক, যারা নন্দীগ্রামে এখনও চুপচাপ, নীরব। নির্বাচনী প্রচার শেষ হয়েছে। সংযুক্ত মোর্চার এই তরুণী প্রার্থীকেও আক্রমণ, হুমকি দিতে ছাড়েনি কেউ। আগামী কাল ভোট। শেষ তিন দিন বাড়ি বাড়ি, পাড়ায়, রাস্তায়, মাঠেঘাটে গিয়ে আমার বন্ধু সাংবাদিক দীপঙ্কর মণ্ডল কথা বলেছেন নানা মানুষের সঙ্গে। খালি পায়ের কৃষক, কলেজে পড়া তরুণ তরুণী, ছোট্ট গুমটি নিয়ে বসা মা, ১৪ বছর আগে জমি রক্ষায় রক্তঝরা পরিবার….. এমন অগুনতি মানুষের থেকে তিনি জেনেছেন চলতি হাওয়া। মাটির দাওয়ায়, চায়ের দোকানে, স্কুলের মাঠে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলেছেন আরও কিছু মানুষের সঙ্গে।
ভাঙাবেড়া, গাংড়া, গড়চক্রবেড়িয়া, সাউদখালি, কেন্দেমারি, রানিচক, টাকাপুরা, আমদাবাদ, খোদামবাড়ি, রেয়াপাড়া, শিবরামপুর, সুবদি, কালিচরনপুর, গোকুলনগর, মহেশপুর, আমগাছিয়া-সহ নন্দীগ্রামের প্রায় সবটা স্পর্শ করেছেন তিনি। ওই যে কাপড় ঘেরা মাটির উনুন, ওটা রান্নাঘর। জমি আন্দোলনের প্রথম শহীদ ভরত মণ্ডলের পারিবারিক রান্নাঘর। শৌচাগার নেই। পানীয় জল বয়ে আনতে হয় অনেক দূর থেকে, এসব তিনিই দেখে এসে বলেছেন আমাদের।
ডানদিকে মোর্চা প্রার্থী মীনাক্ষী। ভোট প্রচারে এই বাড়িতে মমতা বা শুভেন্দু আসেননি। এসেছিলেন মীনাক্ষী, এবার ভোট চাইতে শহীদ পরিবারে। ইভিএম হয়ত তাঁকে বিধানসভায় ঢোকার পাস দেবেনা। তাঁর দরকারও নেই। এসবের বাইরেও তিনি আজ গোটা নন্দীগ্রামের হৃদয়ে ঢুকে পড়েছেন, এই একরোখা কালোমাটির মেয়ে মীনাক্ষী। আগামীর জন্য তাঁর আরও অনেকবড় লড়াই পড়ে রইলো। সেই লড়াই-ই তাঁকে একদিন পৌঁষেদেবে মাটি মানুষের কাছে। তারই প্রস্তুতি পর্বটা যেন, ২০২১ এ-ই লুকিয়ে রাখা হল।