দানের খাবারে, ভরা পেটের উৎসবে আমার অমলিন “ঈদ”

রাধামাধব মণ্ডল :

খুব বেশি দিনের ঘটনা নয়! বিশ্বভারতীর এক পাকা আতেল, আমাকে রবীন সেনের গল্প শোনাতেন! বড় কমিউনিস্ট! বলতেন “চার অধ্যায়ে”র কথা! আমি চুপ করে থাকতাম। অর্থ আর সামাজিক প্রভাবের বাইরের মানুষ ভেবে! কখনো কখনো হীরক রাজার পারিষদের মতো না ইচ্ছেতেও নাড়িয়েছি ঘাড়! ক্রমশঃ বিজেপির তৈরি করা ভোট বিজ্ঞাপনের হাওয়ায়, রবীন সেন উল্টেপাল্টে গেল।

রাম ভক্ত হনুমানের মতো এর ওর সাজানো বাগানে আগুন লাগালেন! ক্রমে ক্রমে শুরু করলেন মনুবাদের ঔদ্বত্য। আর সুপ্ত মুসলমান বিরোধীতাটা ক্রমশঃ সামনে আসতে শুরু হল প্রকাশ্যে! আমার আর আমার বন্ধু সামাদের সঙ্গে দীর্ঘ ঠেকবাজির প্রশ্ন উত্তরে সেদিন ভিজেছিল ফেসবুকের ওয়াল! অনেকের সে কথা মনে থাকবে! পরে সে বন্ধু আমাদের ছেড়ে চলে যায়, বিজেপির মন্ত্রীত্ব পাওয়ার আসায়।

আমার বহু বামপন্থী বন্ধুর সঙ্গে এবার নির্বাচনে রামপন্থী হওয়া নিয়ে দূরত্ব তৈরি হয়। কেবলমাত্র পীরজাদা আব্বাসের জন্যই তাদের এবারে বিজেপিকে ভোট দেওয়া উচিৎ বলেছিল, এই তাদের যুক্তি! অনেকে আবার বলতেন, ইংরেজদের দুশো বছরের ক্ষমতার বিনিময়ে, যাক বাবা মুসলমান শাসকের হাত থেকে রেহাই পেয়েছি! সেই তারা এখন মুসলমানদের বাড়বাড়ন্ত আর হিন্দুদের শেষ হয়ে যাওয়া নিয়ে নানা কথা বলেন! কোন মুসলমান ছেলেটি কোন হিন্দুর বৌ নিয়ে পালিয়েছে সেটা বলে!

তাহলে রামরহিম গুরমিত, আশারাম বাপুদের তারা চিনতে পারে না! তবে এবার এরাজ্যে এমন রামায়ণ কাণ্ড না হলে, আমি তাদের চিনতেই পারতাম না! জীবনের অলক্ষ্যে এমন অযাচিত শত্রুদের সঙ্গে থাকতে হত আজীবন! এখনও অনেককে সহ্য করি, তাদের কিছু সাহায্য আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল একসময় বলে! তাই বলে তাদের কথায়, নজুকাকাকে ভুলবো না! তার দেওয়া ডিম, ছেলেবেলার অভাবি সকালে আমাকে হাঁটতে শিখিয়েছিল।

খোর্দ্দার দেরিয়াপুরের মোল্লা দাদু আমাদের খেতের রাখোয়াল ছিল। হেমন্তের দীর্ঘ মাঠ সে কাকভোরে একা একা ঘুরতো। তাকে সব চাষিরা ধান দিত। সে আমাকে ঘাড়ে চাপিয়ে মাঠেঘাটে ঘোরাতো! প্রকৃতি চেনাতো। তাঁর দেওয়া খেজুরের গুড়, রস খেয়ে আমাদের সে কি আনন্দ! ভাগে পাওয়া ধান বিক্রি করে, সেই মোল্লাদাদু আমাকে একটা ডুরে রঙের সোয়েটার কিনে দিয়েছিল আদর করে। বহুদিন, বহু আত্মীয় বাড়ি গেছি পড়ে।

এখনও মায়ের পুরোনো কাপড়ের মোটে আছে আমার আদরের সেই সোয়েটারটা! দাদু কি যে আনন্দ পেতো, আমি ওটা পড়ে তার সামনে ঘুরে ঘুরে খেলে বেরালে। সেই মোল্লাদাদুর বাবার বাবার নাম ছিল কালাচাঁদ মণ্ডল! আমি আজও আশ্চর্য হই!কে পৃথক করেছিল আমাদের! রাজা বল্লাল সেন? নাকি এখনও সেই অশিক্ষার হিংস্র রাজা রয়েছে, আমাদের কেউ পরিচিতর শরীরে?
ফারহাদদার টাকায়, আমার কতদিনের বই কেনা হয়েছে। মোবাইল কিনে দিয়েছে সে! এ সব কি করে ভুলে যায়!

আমার ছোট দাদু রামকানাই মণ্ডলের মোষের চাষ করার রেওয়াজ দীর্ঘ দিনের। এখনও তাদের মোষ আছে এক জোড়া। পুবারের গেনিদাদু মোষ কেনাবেচার কাজ করতেন। হিরেনপুরের হাট থেকে মোষ কিনে এনে গাঁয়ে গাঁয়ে মোষ বেচে বেড়াতেন। সেই গেনিদাদু আমাদের বাড়ি এলেই আনতেন খুদিরামের দোকান থেকে রসগোল্লা। না আনলেই আমি তাকে কানে ধরে ওঠাবসা করাতাম। পাকাটি দিয়ে মাড়তাম। কখনো কখনো দাদু, তাও সহ্য করেছে। বাড়ি ফেরার সময়, আমার দাদু তার হাতে গোপনে কিছু টাকা তুলে দিতে গেলে, গেনিদাদুর দুচোখ বেয়ে জল পরতো। হায় আল্লা বলে কাঁদতো, দাওয়াতে বসে। দাদু আর কখনো টাকা দিতে যেত না, তাঁকে!

একটু বড় হলে দেখেছি, আমাদের গ্রামের অনেকে গেনিদাদুকে ছুঁইছুঁই করতো! আবার তারাই আগের দিন বিকেলে আমাদের বাড়িতে, গেনিদাদুকে বলে যেতো, গেনি খুব সকালে হাঁটে গিয়ে আমার কাছে কিছু কিনো! গেনিদাদু মাথা নাড়িয়ে চলে যেত বাড়ি! তখন আমিও বুঝতাম না! আসলে মুসলমানের যাত্রা ভালো। তারা কোনো জিনিষ কিনলে বিক্রি ভালো হয়! তাই বিকেলের অছুৎ গেনিদাদুকে, সকালে খাতির করতো তারা!

আজও হিন্দু বিয়ের পবিত্রতা ধরে রেখেছে বিশমিল্লাহ খাঁ সাহেবের সানাই! তিনি মুসলমান নন! তিনি শিল্পী! সে বার ঘোষালদের অনন্তর দিদির বিয়েতে আমি উত্তম কুমারের “আনন্দ আশ্রম” ছবির গান গুলো বাজাতে শুরু করি! চিৎকার করে ওর কাকা তপন ঘোষাল এসে বন্ধ করে দেয়! বলে যতো সব অমঙ্গলের গান! তিনি আবার বিশমিল্লাহ র “সানাই” শুরু করেন!! সেই তপনই মড়াইতলায় না ব্যবহার করা উবুড় করে রাখা, পুরোনো কাপ ধুয়ে এনে রাজমিস্ত্রি গফুরকে চা দেয়! আবার খাওয়া হলে, অযত্নে ফেলে রাখেন মড়াইতলায়।

আমরা এই ঘোষিত হিন্দুরা মুসলমান মিস্ত্রীর তৈরি বাড়িতে হিন্দুত্ব বেচি! সালমান খান, নাসিরউদ্দিন শাহ, সাবানা আজমির ছবি দেখি। তাঁরাও শিল্পী, কোনো মুসলমান নন, এই বোধে হিন্দুত্ব বেঁচি। সাতশো বছরের পাঠান রাজাদের কবলে, বেঁচে থাকা হিন্দুত্ব নিয়ে অশিক্ষা কপচাই! আমার বৌ, আমার মেয়ে মুসলমানের ঘরে গেল দেখি! এতো অশিক্ষার দেশে, কোনো আলো থাকবে না! মুখে মুসলমানের বিরোধীতা করে, মুসলমানের সাহায্য নিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার হিসাব কষি! এই অশিক্ষা, এই বর্বরতাকে, এই মুখোশের বিরুদ্ধে আমার মানবধর্ম জারি থাকবে লড়াইএ।

আজ এই পবিত্র ঈদের দিনে, যে মুসলমানরা এক মাসের নির্জলা উপবাসের পর আমার মতো প্রতিবেশীর জন্য চারদিনের খাবার তুলে দিয়েছেন, আমি সেই মানবতারই প্রতিনিধি। বাড়ি বাড়ি লোহাভাঙা, টিনভাঙা কিনে বেড়ানো ভূঁয়েড়ার গফুর মিয়াঁকেই আমি আমার তিন দিনের অন্নদাতা মানি! তাঁর কষ্টের পয়সায় সে আমার তিন দিনের সংসার চালিয়ে দেয়। পুবারের চটুই ওরফে হানিফচাচার লাচ্ছা, সিমাই আমরা মহানন্দে খাই। লালনের দেওয়া জামা, কাপড় পরে আমরা দুর্গার কলাবৌ আনি! মানবতার এই ঈশ্বর গুলোই সারাবছর আমাদের ভিতরের মাটিকে মন্যুষত্ত্বে জাগিয়ে রাখে!

আমার স্ত্রীর সহজ বক্তব্যের “ঈদ মোবারক ” সম্ভাষণে অনেকেই তির্যক মন্তব্য করেছেন! আমার স্ত্রী কিংবা আমি অক্ষয় তৃতীয়া সম্বন্ধে তেমন কিছুই জানি না! আসলে আমার কাছে “অক্ষয় তৃতীয়া মানে কেবল রাঙাঠাকুমার খটনগরের চাটুজ্জেদের দোকানে নতুন খাতা করতে যাওয়া আর বিকেলে মিষ্টির প্যাকেট খুলে, দুএকটা মিষ্টি খাওয়ার দিন। সেখানে কোনো অনুভব আমি খুঁজে পাইনি। কেবল তৃপ্তিতে নিজের পেট ভরেছে! আর আজ তাদের বলি অনেক বড় হয়ে রামের নাম শুনেছি আমি! এখনও হনুমানকে দেবতা মানি না, মানতে পারিনা!

আমাদের সেবার শশার এতো ক্ষতি করেছিল! তা না হলে, সে বারই কম্পিউটার টা কিনে দিতো দাদু! কেবল বছর ঘুরে মামা বাড়ি ধনকোড়ার চৈত্রগাজনের মেলায় রামায়ণ গান শুনেছি, সেখানেই কিসকিন্দা নগরীর গল্প। বাঁকুড়ার শিল্পীরা এসে গাইতেন, সে গান। পাড়ায় পাড়ায় হনুমানের মৃত্যুদেহ নিয়ে মিছিল আর চাল, টাকা আদায় করে মদ খেয়ে, সেই মৃত্যুদেহ মাটিতে পুঁতে নিশান গেঁদে দিয়ে মচ্ছবের শুরু হল বছর দশেক আগে গ্রামে গ্রামে। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই খেলাটা একশ্রেণির মানুষের তৈরি আর তারাই ছড়িয়ে দেয়। মাতে আর এক শ্রেণি।

কিন্তু ঈদ আমাদের কাছে অনেক বেশি জাগ্রত! এক মাস উপবাসের পর ঈদের দিন, হাট পরলে প্রচুর সব্জি বিক্রি হতো আমাদের গাঁয়ের চাষিদের। মুখে মুখে নির্মল হাসি দেখতাম। আর বিকেল হলেই আসতো প্রচুর প্রচুর ঈদের উপহার, দামি দামি খাবার, পেস্তা কাজুবাদাম..। ভালো ভালো খাওয়া হতো তিন চার দিন। জামা কাপড় আসতো নতুন নতুন! এই ঈদের কাছে কেমন যেন মনমরা হয়ে গেছিলো “দোকানপুজোর” অক্ষয়তৃতীয়া!

আজ অনেকদিন পর আবার ঈদের সকালে আমরা গাইছিলেম সুমনের সেই গানঃ

“আমি চাই সাঁওতাল তার ভাষায় বলবে রাষ্ট্রপুঞ্জে
আমি চাই মহুল ফু্টবে সৌখিনতার গোলাপ কুঞ্জে
আমি চাই নেপালি ছেলেটা গীটার হাতে,
আমি চাই তার ভাষাতেই গাইতে আসবে কলকাতাতে।

আমি চাই ঝাড়খণ্ডের তীরধনুকে,
আমি চাই ঝুমুর বাঁচবে ঝুমুর বাঁচবে তোমার বুকে
আমি চাই কাশ্মীরে আর শুনবে না কেউ গুলির শব্দ
আমি চাই মানুষের হাতে রাজনীতি হবে ভীষণ জব্দ
আমি চাই হিন্দু নেতার সালমা খাতুন পুত্রবধূ
আমি চাই ধর্ম বলতে মানুষ বুঝবে মানুষ শুধু
আমি চাই বিজেপি নেতার সালমা খাতুন পুত্রবধূ
আমি চাই ধর্ম বলতে মানুষ বুঝবে মানুষ শুধু।

আমি চাই গাছ কাটা হলে শোকসভা হবে বিধানসভায়
আমি চাই প্রতিবাদ হবে রক্ত পলাশে রক্ত জবায়
আমি চাই পুকুর বোজালে আকাশ ভাসবে চোখের জলে
আমি চাই সবাই যেন দিন বদলের পদ্য বলে
আমি চাই মন্ত্রীরা প্রেম করুন সকলে নিয়ম করে
আমি চাই, বক্তৃতা নয় কবিতা বলুন কণ্ঠ ভরে
যদি বল চাইছি নেহাত,
যদি বল চাইছি নেহাত
চাইছি নেহাত স্বর্গ রাজ্য
আমি চাই একদিন হবে এটাই রাজ্য।”