তড়িৎ রায় চৌধুরী :
ঠিক একশো বছর আগে এই রকমই এক মে মাসের সকালে ডেনমার্ক ঘুরে সুইডেনের মাটিতে প্রথম পা রাখেন রবীন্দ্রনাথ।স্টকহোমের স্টেশনে উষ্ণ অভ্যর্থনায় ছিলেন সুইডিশ আকাদেমির সম্পাদক কার্ল ফেল্ডট(Karlfeldt), কয়েকজন কাউন্টেস, বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টর,ভারত ভ্রমণে অভিজ্ঞ মিস ওহম্যান (Ohman),কিছু সাহিত্যিক,সম্পাদক ও বহু সাধারণ মানুষ। সুইডেন ভ্রমণ কালে নোবেল জয়ী কবি সাধারণ মানুষের সাহচর্য পেয়েছেন প্রভূত। মুখ্যত নোবেল পুরষ্কার পাবার আট বছর পর নোবেল বক্তৃতা দানের জন্যই পুত্র রথীন্দ্রনাথ সহ তাঁর সুইডেনে আগমন।১৯২১ এর ২৪ মে সেই ঐতিহাসিক দিন।আগের বছরেই আসার কথা ছিল কিন্তু এক মহিলা গুপ্তচরের অতিসক্রিয়তায় তা বাতিল করা হয়।
সাময়িক বিশ্রাম এবং শহর পরিদর্শনের পর সেদিন সন্ধ্যায় লোকসংস্কৃতি সংগ্রহশালার প্রাঙ্গণে সুইডিশ লোকসংগীত ও নৃত্য উপভোগ করেন কবি। ২৫ মে কাটল আরো ব্যস্ততায়। ফেল্ডট আপ্যায়িত করেন মধ্যাহ্নভোজনে।বিখ্যাত লেখিকা সেলমা লেজারলফ(Selma Lagerlof) এসে দেখা করে যান। সুইডেনের রাজা স্বয়ং তাঁকে প্রাসাদে আমন্ত্রণ করে আলাপ করেন এইদিন।সন্ধ্যায় বিভিন্ন সংবাদ সংস্থার উদ্যোগে কনসার্ট হলে বক্তৃতার আয়োজন হয়।আশ্চর্য,মাত্র এক ঘন্টায় সমস্ত টিকিট বিক্রি হয়ে যায়।বঞ্চিত জনতার দাবীতে ঠিক হয় আগামী ২৭ তারিখ তিনি আবারও আর একটি বক্তৃতা দেবেন।এ দিন সভায় রবীন্দ্রনাথ “East and West” প্রবন্ধটি পাঠ করেন।
২৬ শে মে-র মধ্যাহ্নভোজন হয় ‘লীগ অব নেশনস’-এর প্রথম সভাপতি সমাজতন্ত্রী নেতা ব্রান্টিং(Branting)-এর সঙ্গে।মিস ওহম্যান সেদিন কার্ল হ্যামারগ্রেনের ভাইকে এনে আলাপ করান।হ্যামারগ্রেনের প্রতি রবীন্দ্রনাথের ছিল গভীর শ্রদ্ধা।এ দিন বিকাল সাড়ে চারটেয় সুইডিশ আকাদেমিতে হয় নোবেল বক্তৃতা। নোবেল প্রাপ্তির প্রতিক্রিয়া থেকে আরো নানা কথাই এলো সে বক্তৃতায়।তবে গুরুত্বপূর্ণ এক মত উঠে এলো বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে।তিনি বললেন“I do not think that it is the spirit of India to reject anything, reject any race, reject any culture…. It comprehended all things as they are, and not to keep out anything in the whole universe—to comprehend all things with sympathy and love”.
ভারতবর্ষ জুড়ে তখন উত্তাল অসহযোগ আন্দোলন। সব দিক থেকে বিদেশ কে বয়কটের ডাক। রবীন্দ্রনাথ ভোলেন নি সে কথা। বললেন “Now when in the present time of political unrest the children of the same great India cry for rejection of the west। I feel hurt.” আহত হওয়াই স্বাভাবিক। কারন তিনি তখন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির স্বপ্ন দেখছেন।ঐ বক্তৃতাতেই বলেছেন “for that great mission of India I have started this university. I invite you to come to us and help us to make this university to a common institution for the East and West.” তিনি চিরকালই সংযোগবাদী মানুষ, বিয়োগে তাঁর আরাম নেই।
আর তার ভিত এত গভীরে, নিজের আহত হবার কথা প্রসঙ্গে এ কথাও বলেন “I fell that it is a lesson(rejection/বয়কট) which they have received from the West.” পশ্চিমের শিক্ষা!! মনে পড়তে পারে কিছুদিন আগেই ১৯২১-এর মার্চে অসহযোগ আন্দোলন জোরদার করতে গান্ধীজি কটকের জনসভায় বিদেশী শিক্ষা নিয়ে বলেন “Tilak and Ram Mohan would have been far greater men if they had not had the contagion of English learning.” মে মাসেই এই প্রসঙ্গে অ্যানড্রুজ কে এক চিঠি তে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন “Ram Mohan Roy could be perfectly natural in his acceptance of the West.He was never a school boy of the West,and therefore he had dignity to be the friend of the West.if he is not understood by Modern India,this only shows that the pure light of her own truth has been obscured for the moment by the strom clouds of passion.” সমসাময়িক প্যাশান বা আবেগ, যার দ্বারা চালিত হয় গণ-আন্দোলন, সেই দায়ী?
সেদিন রাতে রোজেনবাডে আকাদেমি প্রদত্ত ভোজে উপস্থিত ছিলেন উপশালার আর্চবিশপ,ভূপর্যটক লেখক সভেন হেডেন,এবং আরো নানা গুণীজন। রথীন্দ্রনাথের ডায়েরি বলছে “Archbishop’s speech specially interesting. The Nobel award is for one who combines in himself the artist and the prophet”.শুধু আর্চবিশপ নন ইতিহাস বলে তখন গোটা ইউরোপই এক পয়গম্বর কে দেখছিল কবির ভিতর।এই বিশপের সাদর আমন্ত্রণেই ২৮ শে মে রবীন্দ্রনাথ উপশালা নগরে যান প্রাচীন ক্যাথিড্রাল ও বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে দেখার জন্য।সেখানে প্রাজ্ঞজনদের পাশাপাশি নবীন প্রজন্মের সঙ্গেও তাঁর হৃদ্যতা বিনিময় হয়।তবে তার আগে প্রতিশ্রুতি মতো ২৭ মে সন্ধ্যায় বিপুল জনতার সামনে পড়ে শোনান “The Message of the Forest” প্রবন্ধটি।
এই দিন ব্রিটিশ রাজদূতও এসে অবাক হয়ে যান সুইডেনে কবির সমাদর দেখে।যে কয়দিন তিনি ছিলেন রোজই বিপুল জনতা তাঁর দর্শন প্রত্যাশায় অপেক্ষা করত হোটেলের সামনে। উপশালা থেকে ফিরে ২৮ মে সন্ধ্যার ট্রেনে তিনি বার্লিনের উদ্দেশে রওনা হন।সেদিনের Svenska Tageblatt পত্রিকায় ছবি সহ প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠি।“Bewildered at heart by the demonstrations made in my honour in the Western countries I have often tried to find out their real cause and I have been told because I loved humanity.I hope that it is true and that all through my writings my love of man has found its utterance and touched human hearts across all barriers.”
১৯২৬-এ রবীন্দ্রনাথের ইউরোপ ভ্রমণ তালিকায় সুইডেন ছিল না।তবুও তাঁর হঠাৎ ইচ্ছায় ৩রা সেপ্টেম্বর তিনি সেখানে পৌঁছান।যদিও এবারের তিন দিনের সুইডেন বাস ছিল একেবারেই বন্ধু বৃত্তের ঘেরাটোপে।তারই মধ্যে বন্ধু সভেন হেডেন-এর দৌলতে আলাপ হয় হ্যালস্ট্রম,ওষ্টালিং,মিঃ ও মিসেস লরিন এবং রাজপুত্র উইলহেলম-এর সঙ্গে।এই হেডেন এর লেখাই আমরা পাবো রবীন্দ্রনাথের সপ্ততিবর্ষপূর্তি তে প্রকাশিত The Golden Book of Tagore-এ।