দীর্ঘ করোনাকালে লেখার বাজারে ধস, লেখকের দিন কাটছে সঙ্কটে

একতারা বাংলা, নিউজ ডেস্ক :

এই মহামারির সময়ে কেমন আছেন তিনি! গ্রামে থেকেও তিনি কলকাতা জয়ের স্বপ্ন দেখার সাহস করেছেন! কবিতা দিয়ে শুরু করেছিলেন লেখালেখি, ১১-১২ বছর বয়সে। তারপর কেটে গেছে বহু সময়। আজ তিনি পরিণত। এখন তিনি মহীরুহ-র পথ ধরেছেন, নিজের সহজাত ভঙ্গিতে। তাঁকে পেয়ে বাংলা সাহিত্য অনেক রিদ্ধ হয়েছে, এমন মনে করছেন অনেকে। তাঁর সাফল্যে সমৃদ্ধ হয়েছে তাঁর জেলা পূর্ব বর্ধমানও। জেলার একমাত্র লিখিয়ে তিনি, যিনি কেবল লিখেই জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করেন। প্রতিটি প্রথম সারির দৈনিক কাগজে এবং বাংলা বাঙালির ড্রইং রুমের জনপ্রিয় সাহিত্যের কাগজে তিনি নিয়মিত লেখেন গদ্য। তাঁর গদ্যের ভাষা, তাঁর নিজের হাতে তৈরি। তিনি বই পড়ে লেখেন না, জীবন পড়ে লেখেন।

এখনও পর্যন্ত তাঁর প্রথম দিকের কয়েকটি বই ছাড়া প্রায় সমস্ত বই-ই বাণিজ্যিক সফলতা পেয়েছে। এযাবৎ তাঁর বইয়ের সংখ্যা ২৮টি। পূর্ব বর্ধমানের আউশগ্রামের গণ্ড গ্রাম গোপালপুরের সেই লিখিয়েকে এখন সকলেই এক নামে চেনেন। তিনি রাধামাধব মণ্ডল। কৃষক পরিবারে জন্ম। মাটির গন্ধে বড় হয়ে ওঠা। ছোট থেকেই অভাব আর দারিদ্র্য তাঁর নিত্য সঙ্গী। পরের দানে আর নিজের বই বিক্রির টাকাই তিনি বাংলায় এম এ পাশ করেছেন। বাবা মারা গেছেন ২০১৫ তে। তারপর নিজেই বইছেন সংসারের বোঝা। একার লড়াইএ এখন তিনি সর্বক্ষণের লেখক। লেখেন নানান মাধ্যমে। তাঁর লেখা নিয়ে অডিও ভিজিয়েল মাধ্যমে বেশ জনপ্রিয় হয়েছে, ডাকাত, টহল, ডোম, হানাবাড়ির কথা, লোক গানের গবেষণাধর্মী লেখা গুলি। বিদেশেও তাঁর বহু পাঠক তৈরি হয়েছে। গ্রামীণ লোকজীবন, জনজাতি তাঁর লেখার প্রধান আকর্ষণ।

এই করোনা মহামারির সময়ে তাঁর খোঁজ নিতেই আমরা তাঁর গ্রামে পৌঁছে ছিলাম। এখন সমস্ত কাগজে লেখার টাকা কমিয়ে দেওয়াই তিনি সঙ্কটের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। বই বাজারেও মন্দা। বিক্রি নেই তেমন। বাড়িতে একা একা বসে লেখক লেখেন, স্মৃতির সরণী। অতীত! এই অতীতের স্মৃতি তাঁর কাছে সোনার খনি। সেই মণিমাণিক্যই তিনি লেখেন, তাঁর গদ্যে। টিভি, রেডিও এমনকি আকাশবাণীর টক শো তেও ডাক নেই এখন করোনা পরিস্থিতিতে। করোনার জন্য কমেছে, অনুষ্ঠানের চাহিদাও। লেখক রাধামাধব মণ্ডলকে এবিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন,”আমাদের সঙ্কট বাড়ছে। লেখার বাণিজ্যিকতার পরিসর কমেছে আগের থেকে বহুগুণ। কেউ তেমন পয়সা দিতে পারে না, আগের মতো। বাজারে সঙ্কটের জন্য তৈরি হচ্ছে মনকষ্ট। বিক্রি নেই বইও, তেমন। মানুষের ঘরে ঘরে অভাব। এমন চললে পথে বসতে হবে অচিরেই। ছবির প্রডিউসাররাও আগের মতো এগিয়ে আসছেন না নতুন কাজের ঝুঁকি নিতে। ওই মাধ্যমটিও ধুঁকছে। ফলে এমন চলতে থাকলে, না খেতে পেয়ে মারা যাবো আগামীতে এমন নয়, তবে স্বাভাবিক জীবনের এগিয়ে যাওয়াটা হারাবে নিশ্চিত। এখন যদি সরকার পাশে দাঁড়ায়, তবেই মুক্তি এই সঙ্কট থেকে। আমাদের সেক্টরে অনেককেই কষ্টে রয়েছেন। “

লেখক রাধামাধব মণ্ডলের গল্প অবলম্বনে “রেড স্টারের ক্যাম্প” নিয়ে করোনা কালেই তৈরি হয়েছে নতুন বাংলা সিনেমা “ইস্কাবন”। ছবিটি এখন মুক্তির অপেক্ষায়। আগামী আলোর উৎসবে প্রেক্ষাগৃহে দেখা যাবে ছবিটি নিজের মুখেই বললেন লেখক। তিনি কয়েকটি ওয়েব সিরিজেও গান লিখছেন। নিজের লেখা গানের অ্যালবাম তৈরি হয়েছে। তাঁর লেখা বাংলার ডাকাতদের উপর দীর্ঘ গবেষণার ধারাবাহিক প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন দৈনিকে, সে নিয়েও ছবির কাজ শুরু করতে চলেছেন অচিরেই। এসব সঙ্কটের মধ্যেও তিনি লিখছেন গ্রামের গ্রাম্যজীবন, সাধক ও সাধনা এবং বাউল, ফকির, সাহেবধনী সম্প্রদায়ের উপরেও।

ডেরা জীবন, সাধক জীবন, শবসাধনা, শ্মশান বন্ধুদের গান, ডোমদের উপর, হানা বাড়ি এবং বিভিন্ন পিছিয়ে পড়া জনজীবন নিয়েও তিনি লিখছেন গবেষণাধর্মী লেখা। পুরনো ডাইরির ক্ষেত্র সমীক্ষা শেষের দিকে, একত্রে বাংলার গ্রাম প্রকাশিত হওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা। করোনা কালে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে কাজ করতে যাওয়াও সম্ভব নয়। ফলে নতুন কিছু কাজও শেষ করতে পারছেন না তিনি। আটকে রয়েছে কয়েকটি দীর্ঘ দিনের কাজ। বাংলার গ্রামকে, গ্রামের জীবন, ভাষা, অর্থনীতি এবং সংস্কৃতিকে জানতে রাধামাধব মণ্ডলের লেখা আমাদেরকে নতুন দিকে নিয়ে যায়। ইতিমধ্যেই তিনি দেশ বিদেশের বিভিন্ন কাগজে লিখেছেন গল্প, উপন্যাস এবং প্রবন্ধ। তাঁর প্রবন্ধের ভাষা তাঁর নিজের আলোয় তৈরি।

এই মহামারির সময়ই তাঁর ১৬ টি গল্পের সংকলন “বাঁকবদল” প্রকাশিত হয়েছে, খোয়াই পাবলিশিং হাউস থেকে। এই সংকলনের কয়েকটি গল্প নিয়ে ছবিও নির্মিত হয়েছে। রয়েছে জনপ্রিয় ‘রেড স্টারের ক্যাম্প’ গল্পটিও। হয়তো অন্ধকার সময় কাটলে মুক্তি পাবে তাঁর গল্পের ছবি। আলোক উজ্জ্বল মঞ্চে জ্বলে উঠবে ছবি। কিন্তু লেখকের জীবনে এখন গাঢ় অন্ধকারের ছায়া। তিনি সময় গুনছেন অন্ধকার থেকে মুক্তি পাবার অপেক্ষায়।

Click here for follow us on facebook — Ektara Bangla