রাখী মণ্ডল :
শরতের শিউলি আর কাশের বনে বীরভূমের অজয় তীরের নানুরের খুজুটিপাড়া গ্রাম। একসময়কার বোমা বারুদের গ্রাম আজকে নির্জনতার গভীরে ঢাকা। এই গ্রামের ঘোষ জমিদারদের পুজোতে নিয়মিত প্রতি বছর একবার আসতেন চার দিনের একদিন প্রাক্তন ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের বাবা কামদাকিঙ্কর মুখোপাধ্যায়। সেই সময় প্রণববাবু বয়সে ছোট। শোনা যায় তিনিও এসেছেন কয়েকবার। প্রণববাবুর বাবার সঙ্গে এমনই বন্ধুত্ব ছিল ঘোষবাড়ির। প্রান্ত বীরভূমের এই গ্রামে ডাকাতদলের রমরমাও ছিল প্রাচীন কাল থেকে।
নানুরের ওই এলাকায় মিরাটির মুখোপাধ্যায়দের পুজোর চেয়েও প্রাচীন দুর্গাপুজো খুজুটিপাড়া ঘোষেদের দুর্গা পুজোটু। ১২৫ বছর আগে ১৮৯৪ সালে শুরু হয়েছিল (বাংলার ১২০২ সালে) ঘোষেদের এই দুর্গা পুজো। খুজুটিপাড়া গ্রামের দুই অভিন্ন হৃদয়ের বন্ধু আজীবন ভক্তিপরায়ণ ঈশ্বর রামশরণ ঘোষ ও ঈশ্বর হরিলাল চট্টোপাধ্যায় দীর্ঘ আলোচনা করে একটি দুর্গাপ্রতিমা নির্মাণ করে, সেদিন পুজো শুরু করেন। একজন সৎগোপ ও অন্যজন বন্ধুটি ব্রাহ্মণ বাড়ির। তখনকার সমাজের সেই বাধাবিপত্তি পেড়িয়েই সাধারণভাবে ব্রাহ্মণ বাড়িতে পুজো করার প্রস্তাব দেন ৺রামশরণ ঘোষ। কিন্তু বন্ধু হরিলাল চট্টোপাধ্যায় সর্বপ্রকার সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় রামশরণ ঘোষের বাড়িতেই এক অস্থায়ী আচ্ছাদন তৈরি করে ১৮৯৪ সালে প্রথম পুজো শুরু হয় খুজুটিপাড়া গ্রামে। প্রথম পুজোর পূজারি হন হরিলাল চট্টোপাধ্যায় নিজে এবং তাঁর পরিচিত মহেন্দ্র নারায়ণ চট্টরাজ।
তারপর ধীরে ধীরে ঠাকুরঘরের টিনের ছাউনি, তারও পরে চারচালা টিনের হয়। আরও পর দেবীর আটচালার ঘর রামস্মরণ ঘোষ নির্মাণ করেন , যা এখনও বর্তমান রয়েছে। ১৯৭৮ সালের বিধ্বংসী অজয়ের বন্যায় প্রাচীন দুর্গাঘরটি ভেঙে যায়। রামস্মরণ ঘোষের জৈষ্ঠ্য পুত্র নৃসিংহচন্দ্র ঘোষ দুর্গামন্দিরটি কংক্রিটের নির্মাণ করে দেন। এখনও সে দিনের ঐতিহ্য মেনেই হয় পুজো।
রামস্মরণ ঘোষের জেষ্ঠ্য পুত্র ৺নৃসিংহচন্দ্র ঘোষ প্রথম ‘ইউনিয়ন বোর্ডের’ প্রেসিডেন্ট ছিলেন এবং বিশিষ্ট সমাজসেবী হিসাবে দক্ষিণ নানুরে সুপরিচিত ছিলেন তখনকার দিনে। গ্রামের উন্নতির জন্য স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, পোস্ট অফিস, কুটিরশিল্পক্ষেত্র, আবাসন নির্মাণের জন্য তিনি বহু জমি দান করেন নিজের এলাকায়। নৃসিংহচন্দ্র ঘোষ স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন না, তবে কিন্তু স্বাধীনতার পূর্বে ১৯৪২ সালে ‘বন্দে মাতরম্’ বলার জন্য ব্রিটিশ সরকার তাঁর বন্দুক বাজোয়াপ্ত করে নিয়ে চলে যায়।
পরে অবশ্য সেই বন্দুক উদ্ধার হয় অনেক কষ্টে। গ্রামের যে কোনও গরীব মানুষ মারা গেলে তার শবদাহ করার জন্য তিনি কাঠ ও কয়লার ব্যবস্থা করতেন। করাতেন খাওয়াদাওয়াও। গ্রামের পশ্চিমে চাঁপা পুকুরের পূর্ব পাড়ে স্থায়ী শ্মশান নির্মাণের জন্য জমির ব্যবস্থা করেন তিনিই। ৺নৃসিংহচন্দ্র ঘোষের সময় দুর্গাপুজো মহাধূমধামের সঙ্গে হতো। পার্শ্ববর্তী ২-৩ টি গ্রামের লোককে খাওয়ানোর ব্যবস্থা হত। বর্তমানে জমি বর্গা হওয়ার জন্য ঠিকমতো ফসল না পাওয়াই ওই সব বন্ধ হয়ে গেয়ে। তবে নিষ্ঠার সঙ্গে এখনও রামস্মরণ ঘোষের বংশধরেরা পুজো করে আসছেন। বর্তমানে পূজারি হরিলাল চট্টোপাধ্যায়ের নাতি শ্রীসমীর কুমার চট্টোপাধ্যায় ও তাঁর পুত্র। রামস্মরণ ঘোষের প্রতিষ্ঠিত দু’টি শিবমন্দির রামেশ্বর, ন্যাংটেশ্বর এবং একটি নারায়ণ মন্দির আজও বর্তমান গ্রামে। শিবলিঙ্গ ও নারায়ণের এখনও নিত্যপুজো হয়।
নৃসিংহচন্দ্র ঘোষের পর তাঁর জৈষ্ঠ্য পুত্র শ্রীসূর্য কুমার ঘোষ, মধ্যমপুত্র শ্রীঅংশুকুমার ঘোষ আর তাঁর ভাতৃবৃন্দরা এই দুর্গাপুজো পরিচালনা করেন। বর্তমানে পরবর্তী প্রজন্মের অংশীদাররা এই পুজো করছেন। এখন তার অন্যতম অংশীদার বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সহ-গ্রন্থাগারিক ড. কৌশিক ঘোষ। এবিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি জানান, দাদুর আমলের মতো পুজোতে তেমন জাঁকজমকের পূর্ণ আবহ তৈরি করতে না পারলেও, অতীতের ঐতিহ্য আর নিষ্ঠার কোনও অংশে ঘাটতি থাকে না আমাদের দুর্গা পুজোতে।” অতীত ঐতিহ্য এবং চিরাচরিত প্রথা মেনে আজও বংশো পরম্পরায়; ঢাকি, নাপিত, পুরোহিত ও অন্যান্যরা এই দুর্গা পুজোর সঙ্গে যুক্ত আছেন। বর্তমানে বেশ কয়েক বছর ধরেই ঘোষ বাড়ির ছয় শরিক পুজোর চারদিন এক সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করেন। পুজো বাড়িতে খাওয়ানো হয় কয়েকজনকে। ড. কৌশিক ঘোষ আরও জানান – “বর্তমানে আমাদের গ্রামে অবস্থান রত অন্যান্য ভাইদের অনেকে এবং গ্রামবাসীদের এক বড়অংশের সহযোগিতা ছাড়া ঘোষ বাড়ির পরম্পরা রক্ষা করা সম্ভবপর হত না।” এবিষয়ে গ্রামের মানুষকে তিনি আরও ধন্যবাদ জানান।
Click here for follow us on facebook — Ektara Bangla